সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৪ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ক্রিকেট : সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা

চিররঞ্জন সরকার :
স্বপ্ন ছিল সেমিফাইনালের। কিন্তু সেমিফাইনাল তো দূরের কথা মূল পর্বের একটা ম্যাচেও জয় আসেনি। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র দুটি জয়, তাও পাপুয়া নিউগিনি এবং ওমানের বিপক্ষে। ছয় ম্যাচে হেরেছে, এর মধ্যে একটি স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। ম্যাচগুলোতে তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়ে তুলতে পারেনি। বোলিং-ব্যাটিং ফিল্ডিং সব ক্ষেত্রেই দৈন্য ফুটে উঠেছে। একজন ক্রিকেটারও ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দিয়ে নজর কাড়তে পারেনি। নতুন-পুরনো, সবাই সমান অসফল, দলগতভাবেও চরম ব্যর্থ। একটি-দুটি নয়, বিশ্বকাপে ১১টি ক্যাচ হাতছাড়া করেছেন বাংলাদেশের ফিল্ডাররা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সুযোগ হাতছাড়া করায় দিতে হয়েছে চড়া মাশুল। যারা পেস ও বাউন্সের বিপক্ষে খেলতে পারে না এবং যাদের জোরে শট খেলার সামর্থ্য নেই, তাদের নিয়ে কতটুকুই আর করা যেতে পারে? তাইতো স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হার দিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লজ্জাজনক হার দিয়েই শেষ হয়েছে স্বপ্ন-বধের যাত্রা। অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়ে শূন্য হাতে বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ দল।

ঘরের মাঠে নিজেদের উপযোগী কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের অনুপযোগী পিচ বানিয়ে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে সিরিজ হারানোর বিষয়টিও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্লেষক ও ধারাভাষ্যকারদের অনেকেই বলেছেন, সুপার টুয়েলভের সবচেয়ে বাজে দল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের খুবই জঘন্য পারফরম্যান্সের পেছনে অনেক কারণ, তবে মূল কারণ ঘরে যে বাজে পিচ বানিয়েছে, সেগুলো। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জয় পেয়েছে, কিন্তু সেটা ক্রিকেটের উন্নতিতে কোনো ভূমিকা রাখেনি।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স অবশ্য কখনোই ভালো ছিল না। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশে আয়োজিত দুটি হোম সিরিজ ছাড়া তেমন কোনো কৃতিত্ব নেই। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বিশ্বর‌্যাংকিংয়ের তলানিতে থাকা দেশটির নাম বাংলাদেশ। অথচ ক্রিকেটই এখন বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম খেলা। এখন পর্যন্ত একদিনের ম্যাচে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স মোটামুটি সন্তোষজনক। ওয়ানডের সর্বশেষ র‌্যাংকিংয়ে ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তানের ওপরে বাংলাদেশের স্থান। কিন্তু টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে দলের অবস্থা সে তুলনায় অনেক দুর্বল।

টেস্ট র‌্যাংকিংয়ে ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ নম্বরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানও বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে। আর টি-টোয়েন্টির র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ নম্বরে। গেল বছর ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের কাছে টেস্টে হার দিয়ে যে বিপর্যয় শুরু হয়েছে, তা থেকে আর বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। অভিষেকের পর ২১ বছর হয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনো টেস্টে সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। র‌্যাংকিংয়ে সবচেয়ে তলানিতে থাকা এবং নানা সমস্যা ও সংকটগ্রস্ত ক্রিকেট দল জিম্বাবুয়ে ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো দলের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক কোনো সাফল্য নেই।

খেলাধুলায় ব্যর্থতার ক্ষেত্রে প্রথমেই যে জিনিসটি আলোচনায় আসে, তা হলো টাকা। টাকার কারণে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে পারে না। টাকার অভাবে খেলোয়াড়রা ভালো মাইনে পায় না, ভালো খেতে পারে না, ভালো মতো অনুশীলন করতে পারে না। টাকার অভাবে ভালো মাঠের ব্যবস্থা করা যায় না। আধুনিক সরঞ্জামাদি কেনা যায় না। ভালো প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা করা যায় না। অর্থাৎ টাকার অভাবকে খেলাধুলায় ব্যর্থতার প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ক্রিকেটে সেই সমস্যা নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বরং এখন বিশ্বের অন্যতম ধনী বোর্ডে পরিণত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয়-ব্যয়, নিট উদ্বৃত্ত, নগদ ও ব্যাংক জমা, এফডিআর মিলে বিসিবির স্থায়ী মূলধন বা পুঞ্জীভূত তহবিলে আছে ৮৩২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। আর্থিক অবস্থানে বিসিবি এখন বড় ব্যবধানে পেছনে ফেলেছে দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কাকে।

বছর বছর বিসিবির আয় বাড়লেও সে তুলনায় পারফরমেন্স উন্নত হচ্ছে না। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একমাত্র বৈশ্বিক শিরোপা এসেছে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে, সেটিও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হাত ধরে। তার আগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ নারী দলের এশিয়া কাপ জয়টাই ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিসিবির সবচেয়ে বড় সাফল্য। কিন্তু যে দলকে কেন্দ্র করে বিসিবির এত আয়, নামডাক, মানুষের বিপুল আগ্রহ, সেই দলের সর্বোচ্চ সাফল্য ২০১৯ সালের মে মাসে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়। বিসিবির অনেক টাকা থাকলেও টি-টোয়েন্টিতে দল এখনো তলানিতেই থেকে গেছে। র‌্যাংকিংয়ে দুরবস্থার কারণে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে বাছাই পর্বের বৈতরণ্যী পার হতে হয়েছে স্কটল্যান্ড, ওমান আর পাপুয়া নিউগিনির সঙ্গে খেলে। অথচ আর্থিকভাবে যথেষ্ট পিছিয়ে থাকা যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্রিকেটে নবীন দেশ আফগানিস্তান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছে সরাসরি। তাহলে আর এই বিপুল অর্থ থেকে কী লাভ?

আসলে টাকা নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব। আমাদের ক্রিকেট উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা নেই। ক্রিকেট উন্নয়নে বরাদ্দের সিংহভাগ ঢাকাকেন্দ্রিক। অথচ বেশিরভাগ ক্রিকেটার উঠে আসে বিভিন্ন জেলা, প্রান্তিক এলাকা আর বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) থেকে। আমাদের স্কুল পর্যায় থেকে ভালো ক্রিকেটার তৈরির জন্য পরিকল্পনা নেই। উপজেলা, জেলা ও বিভাগভিত্তিক ক্রিকেট উন্নয়নে বিনিয়োগ নেই। তৃণমূল স্তরে নিয়মিত লিগ-টুর্নামেন্টের আয়োজনের ব্যবস্থা নেই। সেখানে যারা ভালো করবে, তাদের বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ করে দেওয়ার কোনো ম্যাকানিজম নেই।

সবচেয়ে অবহেলিত আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট। যে দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট যত সুবিন্যস্ত, সমৃদ্ধ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সেই দেশে কোয়ালিটি টেস্ট পারফরমারের সংখ্যা তত বেশি। সেই দেশের টেস্ট দলও তত ভালো, শক্তিশালী, সমৃদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের সেই অর্থে গুরুত্বই দেওয়া হয় না। লিগ আয়োজনের কোনো লক্ষ্য-পরিকল্পনা নেই। সময়সূচির বালাই নেই। ঢাকায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগগুলো যথাযথভাবে আয়োজন করা হয় না। এসব লিগের মান নিয়ে গত কয়েক বছরে নিয়মিতই প্রশ্ন উঠছে। আম্পায়াররা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো সিদ্ধান্ত দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘুরেফিরে কয়েকটি বড় দল এই বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। এর আগে দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলার আগেই ফল নির্ধারণ হয়ে যায়। তিনি সরাসরিই পাতানো খেলার অভিযোগ তোলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে বিসিবিকে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

বিসিবির নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়াও ক্রিকেট উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। ঢাকা প্রিমিয়ারের সুপার লিগে ওঠা ৬টি দলের দুটি করে ভোট থাকে বিসিবির নির্বাচনে। এই ছয়টি দলই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিজেদের ছয়টি দলকে সুপার লিগে ওঠাতে বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা হস্তক্ষেপ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কাউন্সিলরশিপ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিসিবি তৃতীয় বিভাগের বাছাই কৌশলে বন্ধ করে দিয়েছে। আগে এন্ট্রি ফি ছিল ৫ হাজার টাকা। এখন করা হয়েছে ৫ লাখ টাকা। এই টুর্নামেন্টে মূলত ৫০-৬০টি অ্যাকাডেমি অংশ নিত। হাজারো কিশোর এসব অ্যাকাডেমিতে খেলত। এখন বাছাই না থাকায় এসব অ্যাকাডেমির আয়ও কমে গেছে। এসব অ্যাকাডেমি এখন বন্ধের মুখে। আবার ৫ লাখ টাকা ফি দিয়ে খেলাও সম্ভব না অনেকের পক্ষে।

যেখানে শত শত কোটি টাকার ছড়াছড়ি, সেখানে প্রভাব থাকবে, দলাদলি থাকবে, অনিয়ম, দুর্নীতি থাকবে। বিসিবিতে রয়েছেও তাই। স্বচ্ছ ভোটাভুটির অভাবের কারণে দুর্নীতিবাজরা নানাভাবে নেতৃত্বে চলে আসছেন। আসলে এখন ক্রিকেট বোর্ডে অনেকেই আসেন টাকা কামানোর ধান্দা নিয়ে। কেউ কেউ আসেন সামাজিক পরিচিতি ও স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য। তারা সত্যিকারের সংগঠক কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। যারা সত্যিকারের সংগঠক, তারা সত্যিকারের খেলাই মাঠে চান। তারা টাকা নয়, দেশের ক্রিকেটের উন্নতি চান, ক্রিকেটকে ঘিরে দেশের কোটি কোটি মানুষের আবেগকে সম্মান দিতে চান, তাদের যে কোনো মূল্যে ক্রিকেট বোর্ডে ফিরিয়ে আনতে হবে।

অনেক বছরের সাধনার ফলে আমাদের ক্রিকেট এখানকার পর্যায়ে এসেছে। যদি নেতিবাচক চর্চা অব্যাহত থাকে তাহলে ক্রিকেট কিন্তু শেষ পর্যন্ত রসাতলে যাবে। এফডিআরের সুদ, আইসিসি থেকে পাওয়া লভ্যাংশ কিংবা স্পনসরশিপ মানি, সব মিলিয়ে বিসিবি হয়তো একটা উন্নত টাকশালে পরিণত হবে, কিন্তু দেশের ক্রিকেট-দারিদ্র্য রয়েই যাবে। বিদেশের মাটিতে জয়ী হওয়ার মতো কোনো ক্রিকেট টিম থাকবে না।

লেখক লেখক ও কলামনিস্ট

chiros234@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION